May 18, 2024, 4:36 am

নিউমার্কেটের সংঘর্ষে তৃতীয় পক্ষে কারা

নিউমার্কেটের সংঘর্ষে তৃতীয় পক্ষে কারা

Spread the love

রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন ও হেলমেট বাহিনীকে শনাক্ত করতে গিয়ে গলদঘর্ম আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই তৃতীয় পক্ষকে বের করাই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে একাধিক সংস্থার অনুসন্ধানে কিছু তথ্য মিলেছে বলে জানা গেছে। ওই ঘটনায় পুলিশ ও নিহত দুই যুবকের পরিবার মোট ৪টি মামলা করেছে। ধরা পড়েছে সন্দেহভাজন কয়েকজন।

সিসিটিভি একাধিক ফুটেজ বিশ্লেষণ, ফোনের অডিও রেকর্ড পর্যালোচনা ও দোকানকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে সংঘর্ষের সূত্রপাতের সঙ্গে ঢাকা কলেজের তিন ছাত্রলীগ কর্মী লিটন, মাসউদ ও নাসিমের সরাসরি সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে। তবে তুচ্ছ ঘটনায় এত বড় সংঘর্ষের মোড় নিল কেন, এর পেছনে কারা, এর জবাব বের করতে সব সংস্থা ব্যাপক তৎপর।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ এরই মধ্যে সেদিনের ঘটনায় হেলমেট বাহিনীর ১২ সদস্যকে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করেছে। তারা জানতে পেরেছে, ওই সংঘর্ষের সময় বিক্রয়কর্মী নাহিদ হাসানকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে গুরুতর আহত করে হেলমেট বাহিনীর সদস্যরা।

গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, নাহিদকে কুপিয়েছে ঢাকা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের রাব্বী নামের এক শিক্ষার্থী। তিনি থাকেন কলেজের নর্থ হলে। আর নাহিদকে দুইজন রামদা দিয়ে এবং মোরসালিনকে একজন রামদা কুপিয়েছে। নাহিদকে যারা কুপিয়েয়েছে, তাদের একজনের মাথায় কালো রঙের হেলমেট ছিল। হাতে ছিল রামদা, পরনে কলাপাতা রঙের টিশার্ট। এ ছাড়া আরও ২০ থেকে ৩০ জন নানাভাবে হামলায় অংশ নেয়।

নাহিদের ওপর নুরজাহান মার্কেটের ৩ নম্বর গেটের ১৯৫ নম্বর দোকানের সামনে হামলা হয়। হামলাস্থলে ৬টি স্টিলের খুঁটি ফুটপাতে বসানো রয়েছে। দক্ষিণ দিকের তিনটি স্টিলের খুঁটির পাশেই নাহিদকে কোপায় সেই হেলমেট পরা যুবক। হেলমেট পরে যারা ওই সংঘাতে জড়িয়েছিলেন, তাদের অধিকাংশই ছাত্র বলে গোয়েন্দা পুলিশ জানালেও অদ্যাবধি কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি তারা। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, তারা প্রতিটি ভিডিও বিশ্লেষণ করছেন, শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার পর গ্রেপ্তার অভিযানে যাবেন। সংঘর্ষের সময় নিহত দোকানের কর্মচারী মুরসালিনের পরিবারের পক্ষ থেকে যে হত্যা মামলা করা হয়েছে, তার তদন্তের দায়িত্ব ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ পেয়েছে বলে জানা গেছে।

ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, কর্তব্যরত সাংবাদিক ও অ্যাম্বুলেন্সের ওপর হামলা কোনো ছাত্র বা ব্যবসায়ীর কাজ হতে পারে না। এখানে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে নানা বয়সী কয়েক শ মানুষ হেলমেট পরে ঘটিয়েছে রক্তক্ষয়ী সেই ঘটনা। গত শুক্রবার শিক্ষামন্ত্রীও বলেন, ‘তুচ্ছ ঘটনা কেন্দ্র করে নিউমার্কেটে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের সংঘাত ছড়িয়ে দিতে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন ছিল। যে দোকান থেকে সংঘাতের সূত্রপাত, আমরা তাদের রাজনৈতিক পরিচয় জেনেছি। সুতরাং কোনো অবস্থায়ই এদের ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।’ অন্যদিকে নিউমার্কেটে প্রাণক্ষয়ী সংঘর্ষের জন্য আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে দায়ী করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

ঢাকা কলেজ কর্তৃপক্ষও সংঘর্ষের পেছনে উসকানির কথা বলেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে- তৃতীয় পক্ষ এই হেলমেট বাহিনীর সেদিনের নাটাই ছিল কার হাতে। নিয়ন্ত্রক ছিলেন কে বা কারা? কার নির্দেশে হেলমেট বাহিনী হামলায় অংশ নিয়েছে।

গতকাল পর্যন্ত বিএনপি নেতা মকবুল হোসেনকে গ্রেপ্তার ছাড়া দৃশ্যত কোনো অগ্রগতি নেই নিউমার্কেটের ঘটনায় দায়ের করা ৪ মামলায়। যদিও তার নিজেরও দুটি দোকান রয়েছে। ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত নয়, প্রাথমিকভাবে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে। যদিও এখন পর্যন্ত তদন্ত কর্মকর্তারা তৃতীয় পক্ষের বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলছেন না।

তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায় আমাদের সময়কে বলেন, ‘কারা ওইদিন হেলমেট পরে হামলা করেছিল, তাদের পরিচয় নিশ্চিত হতে নানামুখী তদন্ত করা হচ্ছে। এজন্য ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজসহ বিভিন্ন সোর্স থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে।’

এদিকে সংঘর্ষের সময় পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে করা মামলায় গ্রেপ্তার বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট মকবুল হোসেনের তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল শনিবার তাকে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। এর পর মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাকে সাতদিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন নিউমার্কেট থানার পুলিশ পরিদর্শক হালদার অর্পিত ঠাকুর। শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশীদ তার তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

এর আগে গত শুক্রবার বিকালে রাজধানীর ধানমন্ডির বাসা থেকে মকবুল হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই সংঘর্ষের ঘটনায় উভয়পক্ষের অর্ধশতাধিক আহত হন। সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত দুজন মারা গেছেন। তাদের একজন ডেলিভারিম্যান, অন্যজন দোকান কর্মচারী।

ঢাকা নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ডা. দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহিন গত রাতে আমাদের সময়কে বলেন, ‘হামলায় তৃতীয় পক্ষ অর্থাৎ হেলমেট বাহিনী জড়িত। কারণ সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় নিউমার্কেটের ভেতরে থাকা ওয়েলকাম ও ক্যাপিটাল ফাস্টফুড নামে দুই দোকান কর্মচারীর দ্বন্দ্ব থেকে। এর পর তারা কলেজের শিক্ষার্থীদের ডেকে নিয়ে আসে; বাধে সংঘর্ষ। এর পর মার্কেটের সব গেট বন্ধের নির্দেশ দিলে তা কার্যকর করা হয়। পরে এক নম্বর গেট দিয়ে ব্যবসায়ী ও দোকান কর্মচারীরা যার যার বাসায় ফিরে যান। এর পর থেকে শুধু সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার জন্য আমিসহ কয়েক ব্যবসায়ী ছিলাম মার্কেটে। তা হলে সকালে ছাত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াল কারা। হেলমেট পরিহিতরাই বা কারা। কী তাদের পরিচয়। ভিডিওতে দেখা গেছে, ধাওয়া পাল্টাধাওয়ার পর ওই হেলমেট পরিহিতরা কলেজের ভেতর অবস্থান নিয়েছে। তারা কেউই মার্কেটে ঢোকেনি।’

ত্রিমুখী সংঘর্ষের সময় নাহিদের ওপর কীভাবে হামলা করা হয়েছে তার একটি ভিডিও আমাদের সময়ের হাতে এসেছে।? ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, কালো হেলমেট, কলাপাতা রঙের টি-শার্ট ও জিন্সের প্যান্ট পরা এক যুবক হাতে রামদা নিয়ে তাকে কুপিয়ে যাচ্ছেন। এ সময় ছুটে গিয়ে হলুদ শার্ট পরা এক যুবক তাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছেন। একই সময়ে লাল হেলমেট পরা আরেক যুবকসহ কয়েকজন হামলাকারীকে টেনে নিয়ে আসে। এর কিছুক্ষণ পর শতাধিক হেলমেট পরা ব্যক্তির সঙ্গে নিউমার্কেট ব্যবসায়ীদের ধাওয়া পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

সেই সময়ের ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, নিউমার্কেট ব্যবসায়ীদের একজন যুবক নাহিদকে মুমূর্ষু অবস্থায় মাটি থেকে তুলে পাঁজাকোলা করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন; কিন্তু ওই সময়ে হেলমেট বাহিনী তাদের ধাওয়া দিলে নাহিদকে রেখে তারা পালানোর চেষ্টা করেন। হলুদ, লাল এবং কালো হেলমেট ধারী সেই তিন যুবক এখন পর্যন্ত রয়েছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। তারা যে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী- এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে।

জানা গেছে, হামলার সময় ব্যবসায়ীদের হাতে লাঠি, ইটপাটকেল ছাড়া আর কিছু ছিল না; কিন্তু হেলমেট বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যেকের হাতে রামদা, রড, হকস্টিক, স্টিলের হাতল, ভাঙা কাঠ ছিল।

গত মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী ও কর্মচারীদের সংঘর্ষ হয়। প্রায় আড়াই ঘণ্টা চলে এ সংঘর্ষ। এর পর রাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেও ১৯ এপ্রিল সকাল ১০টার পর থেকে ফের দফায় দফায় শুরু হয় সংঘর্ষ, চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে দুটি মামলা করে। একটি মামলা বিস্ফোরক আইনে এবং অন্যটি পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে করা হয়। দুই মামলায় নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী, কর্মচারী ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীসহ মোট ১২০০ জনকে আসামি করা হয়। এ ছাড়া সংঘর্ষে নিহত নাহিদের বাবা মো. নাদিম হোসেন ও মুরসালিনের ভাই নুর মোহাম্মদ বাদী হয়ে নিউমার্কেট থানায় দুটি হত্যা মামলা করেন। এই চার মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে প্রায় এক হাজার ৪০০ জনকে।

খবর আমাদের সময়


Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     More News Of This Category