May 3, 2024, 9:37 pm

বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চার সমস্যা এবং সম্ভাবনা

Spread the love

বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চার সমস্যা এবং সম্ভাবনা

বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র সৃষ্টির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির অংশ বা দ্বিতীয় ভাগের ১১ নং অনুচ্ছেদ রাখা হয় “গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার”। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ১১ নং অনুচ্ছেদে রাখা হয় প্রজাতন্ত্র হইবে গণতন্ত্র। আমরা জানি যে, গণতন্ত্র বিকশিত হয় ধারাবাহিক চর্চার মাধ্যমে। বাংলাদেশের যাত্রা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মাধ্যমে শুরু হলেও তার বেশিদূর এগুতে পারেনি। ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সামরিক স্বৈরশাসন অব্যাহত ছিল। ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৯০ সালে সামরিক স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। অতপর আশা জেগেছিল যে এইবার গণতন্ত্রের চর্চা শক্তিশালী হবে। কিন্তু সামরিক শাসন অবসানের পর বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ১৯ বছর অতিক্রম করেছে। এই সময় ৫টি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও গণতন্ত্র যে দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড়ায়নি তা একবাক্যে বলা যায়। আমি মনেকরি বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চা শক্তিশালী না হওয়ার পেছনে দুই ধরনের বাধা ভূমিকা রাখে। প্রথমতঃ সংস্কৃতিগত বা আচরণগত, দ্বিতীয়ত সাংবিধানিক। এই বাধা সমূহ অতিক্রম করে কিভাবে গণতেন্ত্রর চর্চা শক্তিশালী করা যায় তা আলোচনা করা প্রয়োজন।

গণতন্ত্র চর্চার বাঁধা:

Untitled 1 1
পরস্পর বিরোধী 
অসহিষ্ণুতা: গণতন্ত্রের চর্চার অন্যতম শর্ত হলো সহিষ্ণু এবং আপোস ও সমঝোতার মানসিকতা। গণতন্ত্র তখনই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করতে পারে যখন রাজনৈতিক নেতারা আলাপ আলোচনা এবং আপোস সমঝোতায় রাজি থাকেন, কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো, যুক্তিসংগত সমঝোতার পরিবর্তে “হয় সব, নতুবা কিছুই নয়”। বর্তমানে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে এবার কিছুটা আশার মখ দেখা গেলেও তা এখনও তার কোন ফলাফল পাওয়া যায়নি।
দলীয় গণতন্ত্রের অভাব: বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিশেষ করে যারা ক্ষমতায় আছে বা ক্ষমতায় ছিল এরা কোন দলই স্বচ্চজবাবদিহি মূলক নেতৃত্ব নির্বাচন পদ্ধতি নেই। এই দলগুলো নেতানেত্রী এমনকি কমিটি নির্বাচনের দায়িত্ব পর্যন্ত ব্যক্তির হাতে বা তার ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। যেমন ২০০৯ সালের আওয়ামিলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শুধু মাত্র সভানেত্রী এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ডিসেম্বর ২০০৯ বি.এস.পির কাউন্সিলে একজনও নির্বচিত হননি বরং কাউন্সিল চেয়ারপারসনকে কমিটি ঘোষণার দায়িত্ব অর্পন করে। দলের ভিতরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অনুপস্থিতির কারণে গোষ্ঠি ও উপদলীয় কোন্দল সৃষ্টি হয়। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের বৃহত্তম দল বিএনপি অংশগ্রহণ করনি তাদের অনুপুস্থিতিতেই নির্বাচন হয়েছে, যুক্তি হিসেবে তারা তত্তাকধায়ক সরকার এর দাবি দাড় করেছিলেন। একারণে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর অসংখ্য উপদলের সমাহার।  এই উপদল গুলো সময় এবং অবস্থা বুঝে তাদের আনুগত্যের পরিবর্তন ঘটায় যা বর্তমানে দৃশ্যমান।
নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনা:  বাংলাদেশে নির্বাচিত দলের প্রধান দেশের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন কিন্তু তিনি কখনই দলীয় প্রধানের পদ ত্যাগ করেন না একই ভাবে দলের মহাসচিব মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেও দলীয় পদ ছেড়ে দেন না। যদি তারা দলীয় পদ ছেড়ে দিয়ে শধু মাত্র সরকারি পদ ধারন করতেন তাহলে দলে আরও নেতৃত্বের বিকাশ হতো। ভারতসহ যে কোন গণতান্ত্রিক দেশে সরকার প্রধান অথবা মন্ত্রিসভার সদস্য হলে দলীয় পদ ত্যাগ করেন। 
প্রার্থী মনোনয়ন: বাংলাদেশে বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় নির্বাচনের সময় দলীয় প্রার্থী ত্রিনমূলের নেতা কর্মীদের ইচ্ছা মাফিক হয় না। সাধারণত ৩০০টি আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেন দলের প্রধান। এ কারণে দলের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চার করার সুযোগ নেই। মনোনয়ন নেবার জন্য প্রার্থীরা বিভিন্ন কৌশল অবলম্নন করেন টাকার খেলা চলে ফলে যোগ্য প্রার্থী মনোনয়োন পাই না।
সাংবিধানিক বাধা: বাংলাদেশের সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা আছে যে “প্রজাতন্ত্র হইবে গণতন্ত্র” কিন্তু এই সংবিধানেই এমন শর্ত রয়েছে যা গণতন্ত্র চর্চায় বাধা, যেমন ঃ 
প্রধানমন্ত্রীর অসীম ক্ষমতা: বাংলাদেশের সকল ক্ষমতা প্রকৃত অর্থে এক ব্যক্তির হাতে জমা। ১৯৭৫-১৯৯০ পর্যন্ত এই অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী ছিল রাষ্ট্রপতি এবং ১৯৯০ সালের পর তা এসে পড়েছে প্রধানমন্ত্রীর উপর। সংসদীয় রাজনীতিতে প্রধানমন্ত্রীকে বলা হয় ÒPrimminister First Among the Ministers” কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো প্রধানমন্ত্রী শুধু ১ নম্বর নয় বরং সকল ক্ষমতার অধিকারী। এটি গণতন্ত্রের জন্য বাধা।
সংবিধানের ৭০ নং ধারা/ অনুচ্ছেদ : বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ নং অনুচ্ছেদ মোতাবেক দলীয় কোন সংসদ সদস্য দলের সিদ্ধােন্তর বাইরে ভোট দিতে পারেনা। যদি কোন সদস্য দলের সিদ্ধান্ত না মেনে বিপক্ষে ভোট দেন তাহলে তার সদস্য পদ খারিজ হয়ে যায়। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ কোন সিদ্ধােন্তর কারণে ভোটের সময় কোন সংসদ সদস্য যদি অনুপস্থিত থাকেন অথবা উপস্থিত থেকে ভোট দানে বিরত থাকেন তাহলেও তার সদস্য পদ খারিজ হয়ে যায়। বিশ্বের কোন গণতান্ত্রিক দেশে এরূপ সাংবিধানিক বিধান নেই। অর্থাৎ সংবিধানের ৭০ নং অনুচ্ছেদ গণতন্ত্র চর্চায় অন্যতম বাধা।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চা শক্তিশালী করার জন্য প্রয়োজন নিরপেক্ষ নির্বাচন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, শক্তিশালী স্থানীয় সরকার, ৭০ নং অনুচ্ছেদ বাতিল, নারী সদস্যদের সরাসরি ভোটে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা সহ আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধ করতে হবে।
নিরপেক্ষ নির্বাচন : গণতান্ত্রিক সমাজের প্রথম এবং প্রধান শর্ত হল নিরপেক্ষ নির্বাচন। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদের নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন ছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যলয়ের অধীন। এতে করে রাজনৈতিক সরকার নির্বাচনের ফলাফল অনুকূলে আনার জন্য নির্বাচন কমিশনেকে প্রভাবিত করতে পারত। বর্তমান  নির্বাচন কমিশন এর দাবি নির্বাচনের জন্য এযাবৎ প্রণীত আইন, বিধি, প্রবিধি এবং নীতামালা সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পরিচালনার জন্য যথেষ্ঠ। তা ছাড়া নির্বাচন কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিক ও দাপ্তরিক সক্ষমতাও মানসমম্মত যার সাহায্যে ইতিপূর্বে গ্রহণযোগ্য এবং প্রশংসিত নির্বাচন অনুষ্ঠান পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বিরধী অনান্য দল এই দাবি মানতে নারাজ। এতে করে বোঝা যাচ্ছে এখনও সঠিক বা গ্রহনযোগ্য নিরাপেক্ষ নির্বাচন কমিশন এখন তাদের জায়গায় আসতে পারে নাই।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: প্রকৃত অর্থে আইনের শাসন ব্যতীরেখে গণতন্ত্র বিকশিত হয়না। আইনের শাসনের জন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অপরিহার্য। ২০০৭ সালে বিচার বিভাগকে সংস্থাপণ মন্ত্রনালয়ের অধীন থেকে পৃথক করা হয়েছে। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়ার এখনও সকল মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারে নাই।
শক্তিশালী স্থানীয় সরকার:  একটি দেশের গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার শক্তিশালী করার বিকল্প নেই। স্থানীয় সরকার শক্তিশালী হলে জনগণ ব্যাপকভাবে রাজনীতির সাথে জড়িত হবে এবং স্থানীয় উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট হবে। একই সাথে নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পাবে। তাহলে গণতন্ত্র বিকশিত হবে। 
৭০ নং অনুচ্ছেদ বাতিল করতে হবে:  সংবিধানের ৭০ নং অনুচ্ছেদ কার্যত গণতন্ত্রের জন্য বাধা। এই ধারার কারণের কোন সংসদ সদস্য প্রয়োজনে নিজস্ব মতামত উপস্থাপন করতে পারেন না। এই ধারা মোতাবেক দলের সিদ্ধান্ত না মেনে ভোট দিলে তার সদস্য পদ খারিজ হয়ে যায়। তাই আমি মনেকরি সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ৭০ নং ধারার পরিবর্তন করা প্রয়োজন।
 আইনের অপপ্রয়োগ:  বাংলাদেশে প্রায়ই আইনের অপপ্রয়োগ হয়ে থাকে। এটি গণতন্ত্রের জন্য বাধা যেমন Special Power Act” এর মাধ্যমে যে কোন অপরাধীকে সরকার চাইলে Detention দিতে পারে। এটি যদি রাজনৈতিক কারণে প্রতিপক্ষের উপর প্রয়োগ করা হয় তাহলে তাকে অপপ্রয়োগ বলা যায়। আমি মনেকরি গণতন্ত্রের চর্চাকে শক্তিশালী করার জন্য আইনের সঠিক প্রয়োগ করতে হবে। 

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     More News Of This Category