May 2, 2024, 10:17 pm

freedom friter

মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র সমাজের ভূমিকা

Spread the love

মো: হাসিব উদ্দীন চঞ্চল, সম্পাদক বিডি সোশ্যাল নিউজমহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র সমাজের ভূমিকা

আমাদের দেশের ছাত্রসমাজের রয়েছে এক গৌরবজ্জোল ইতিহাস। দেশের ইতিহাসে প্রত্যেকটি বড় বড় আন্দোলন ও সংগ্রামে ছাত্র সমাজের রয়েছে স্বতঃস্ফ‚র্ত অংশগ্রহণ। ’৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯ এর গণ আন্দোলন এর মতো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে এদেশের ছাত্র সমাজ স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ করে এক অভূতপূর্ব অবদান রাখে। স্বাধীনতার দাবীতে ছাত্র সমাজই মুখ্য ভূমিকা কর্মসূচিপালন করে জয় করে এনেছে লাল সবুজের পতাকা। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্র সমাজ এককভাবে কোন সংগঠন বা দলের হয়ে নয় বরং সামগ্রিতভাবে বিভিন্ন আঞ্চলিক বাহিনী, স্বেচ্ছাাসেবী সংগঠন ইত্যাদির মাধ্যমে লড়াই করেছে। এদের মধ্যে অন্যতম হল টাঙ্গাইলের কাদেরবাহিনী, দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের হেমায়েতবাহিনী, ময়মনসিংহ এলাকার আফসারবাহিনী ইত্যাদি।

বাংলা চাই’দাবির আন্দোলনে সহযোদ্ধা হয়ে পুরুষের পাশে এসে দাঁ
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ শুরু হয় আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণার পূর্ব থেকেই। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। ২ মার্চ, ১৯৭১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র সভায় দেশের পতাকা প্রথম উত্তোলনের মাধ্যমে এই মহান আন্দোলনে ছাত্র সমাজ তাদের অগ্রণী ভূমিকার যাত্রা শুরু করে। ২৫ মার্চ ১৯৭১ এর কালো রাত্রে পাকিস্তানী বাহিনী তাদের নিধনযজ্ঞ কর্মকান্ড এর মাধ্যমে এদেশের জনগনের কন্ঠস্বর স্তদ্ধ করতে চায়। দেশের আপামর জনসাধারণ তখন এক ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যে দিনযাপন করতে থাকে। প্রত্যেকে তখন তার নিজ নিজ নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দেশের এই সংকটকালীন সময়ে ছাত্র সমাজ এককভাবে সংগঠিত না হয়ে বরং বিভিন্ন বাহিনীর ভিতর ঢুকে তাদের সর্বোচ্চ সাধ্যমত প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে।

ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস

স্বাধীনতার যুদ্ধে দখলদার পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনের জন্য দেশের সমগ্র অঞ্চলকে কয়েকটি সেক্টরে ভাগ করা হয়। এছাড়া আঞ্চলিক কিছু বাহিনীসহ সমগ্র জাতি বিভিন্নভাবে এই মহান আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয়। ঢাকা শহর ছিল ২নং সেক্টরের অধীন। স্বাধীনতা যুদ্ধে ঢাকা শহরে ছাত্রদের গেরিলা আক্রমণ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য গেরিলারা সাধারণত কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্ত ব্যবহার করত। ঢাকার গেরিলা আক্রমণ পরিচালনা করা হত “ক্র্যাক প্লাটুন” নামক গেরিলা গ্রæপের মাধ্যমে। এই আক্রমণের মূল কাজ ছিল ছোট ছোট গ্রæপে বিভক্ত হয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা, যাতে করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা দখলদার বাহিনীকে সহজেই ঘায়েল করা যায়। ৯ জুন ১৯৭১ তৎকালীন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে (বর্তমানে শেরাটন হোটেল) প্রথম বিষ্ফোরণ ঘটানোর মাধ্যমে এই আক্রমণের সূচনা করা হয়।

এরপর একে একে গেরিলা অভিযান পরিচালনা করা হয় যথাক্রমে ফার্মগেটের আর্মি চেকপোস্টে, আসাদ গেট এলাকায়, পাকিস্তানী ন্যাশনাল ওয়েল এর পেট্রোল পাম্পে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানী প্রাক্তন গভর্ণরের বাসভবনে, সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে, গুল টেক্সটাইল মিলে, মগবাজার ওয়ারলেস সেন্টার তথা টিএন্ডটি কলেজে। অধিকাংশ অভিযানে গেরিলা যোদ্ধারা গ্রেনেড বিস্ফোরণ এর পর অতর্কিত গুলিবর্ষণ করতে করতে পাক সেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ সকল অভিযানে পাকিস্তানী বাহিনী মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে। অরদিকে দেশপ্রেমিক জনতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার অনুপ্রেরণা বহুগুনে বৃদ্ধি পায়।

কাদেরবাহিনী:
মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের বিভিন্ন পেশার লোকদের সাথে ছাত্রসমাজ নিয়ে গঠিত উল্লেখযোগ্য যে কয়টি গেরিলাদের বীরত্বপূর্ণ কার্যক্রম পরিচালনা করে তাদের মধ্যে কাদেরবাহিনী, হেমায়েতবাহিনী ও আফসারবাহিনী অন্যতম। এক্ষেত্রে কাদের বাহিনীর নাম মহান মুক্তিযুদ্ধে একটা উপাখ্যান হয়ে আছে। ১৬ হাজার গেরিলা সদস্য এবং ১৫০০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে পুরো টাঙ্গাইল জেলা, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও পাবনা জেলার কিয়দংশ নিয়ে এই বাহিনী অপারেশন পরিচালনা করে। এ বাহিনীর গেরিলাদের জন্য মধুপুরের গভীর জঙ্গলে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। পাকিস্তানী বাহিনীকে পরাস্ত করতে এ বাহিনীর রণকৌশল ছিল “আঘাত কর এবং সরে পড়”। পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে কাদের বাহিনীর প্রথম যুদ্ধ হয় ২২ মে, ১৯৭১ চারণ এলাকায়। এরপর ৩ জুন এ বাহিনীর সদস্যগণ গোপালপুর, মধুপুর এবং ঘাটাইল থাকা আক্রমণ করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দখলে নেয়। ১২ জুন কালিহাতির বল্লা নামক স্থানে পাকিস্তানী বাহিনীর বড় একটি দলকে প্রতিহত করে। ১১ আগষ্ট ধলেশ্বরী নদীতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বোঝাই পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর জাহাজে আক্রমণ করে। এতে জাহাজ ডুবে যায় ও ১০০ শত্রæ সেনার সলিল সমাধি ঘটে। ২০ নভেম্বর ১৯৭১, ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলের দিকে অগ্রসরমান পাকিস্তানী বাহিনীকে একটি ব্রিগেড আক্রমণ করে পিছু হটতে বাধ্য করে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাই অসংখ্য ছাত্র দিয়ে গঠিত কাদের সিদ্দিকীর কাদের বাহিনীর অবদান একটি বিশেষ অধ্যায় হয়ে আছে।

হেমায়েত বাহিনী:
হেমায়েতবাহিনীর প্রধান ছিলেন ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় জন্মগ্রহণকারী হেমায়েত উদ্দিন। দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে হেমায়েত বাহিনী। জয়দেবপুর সেনানিবাসের একজন হাবিলদার হেমায়েত উদ্দিনের গড়া বাহিনীতে ছাত্রদের প্রাধান্য ছিল বেশি। কোটালীপাড়ার জাহেরের কান্দি হাই স্কুলে এই বাহিনীর অস্থায়ী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ৪ হাজার ছাত্র যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তিন মাস ধরে যাদের অস্ত্রের উৎস ছিল পাকিস্তানী বাহিনী থেকে জব্দ করা অস্ত্র ও গোলাবারুদ। হেমায়েত বাহিনীর ১৮টি সফল অপারেশন এ অঞ্চলের পাক বাহিনীকে দুর্বল করে তোলে।
হেমায়েতবাহিনীর একটি সাহসী অপারেশন ছিল ৩ জুন ১৯৭১। এদিন রাত্রের গভীরে হেমায়েতবাহিনীকে আক্রমণ করতে পাক বাহিনী খালের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। খবর পেয়ে রাত দুটার দিকে উক্ত খালের উভয় পাড় হতে হেমায়েতবাহিনী শত্রæ সেনার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। পাক বাহিনী এতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। অসংখ্য পাক সেনা এই অভিযানে নিহত হয়। এর চারদিন পর ৭ জুন পাক বাহিনী তিনটি স্টিলবডি লঞ্চে করে এসে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য হেমায়েতবাহিনীকে আক্রমণ করে। কিন্তু গেরিলা হেমায়েতবাহিনীর আক্রমণে এবারও তারা পরাজিত হয়ে কাপুরুষের মত পলায়ন করতে বাধ্য হয়। দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীর অনেক শক্তিশালী আক্রমণ এভাবে হেমায়েতবাহিনী প্রতিহত করে।

আফসারবাহিনী:
ময়মনসিংহের কমান্ডার আফসার উদ্দিনের নেতৃত্বে ছাত্র জনতা কর্তৃক গঠিত মুক্তিযদ্ধের আরেকটি গেরিলা বাহিনী হল আফসারবাহিনী। আফসারবাহিনীতে ছিল ৪৫০০ জন স্বেচ্ছাসেবী, যাদেরকে ২৫টি কোম্পানীতে বিভক্ত করা হয়। ২ মে ১৯৭১ থেকে শুরু হয় এই বাহিনীর আক্রমণ। প্রথম ভালুকা থানা আক্রমণ এবং অস্ত্রাগার লুট করলে পাকিস্তানী বাহিনী ২৫ জুন তিনদিক থেকে ভালুকা থানা আক্রমণ করে। আফসারবাহিনী বাজুবাজারে পাকবাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। নিহত হয় ১৫০ জন পাক সেনা এবং আহত হয় আরো অনেক। দ্বিতীয়বার ২৮ জুন নিহত হয় আরও ১৭ জন সেনা কর্মকর্তা। ১৯ জুলাই ভালুকা থানার সীড স্টোর বাজারে আফসারবাহিনী পাক সেনাদের ক্যাম্পে আক্রমণ করে ২৩ জনের সলিল সমাধি সাধন করে। এভাবে আফসারবাহিনী মুক্তিযুদ্ধকালীন তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।

নৌ-বাহিনী:
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নৌ-কমান্ডারদের অবদান এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। পাকিস্তান নৌ বাহিনীতে অন্তুর্ভূক্ত বাঙ্গালী অনেক সাব মেরিনার এ সময় ফ্রান্সে প্রশিক্ষণরত ছিল। প্রশিক্ষণ অসম্পূর্ণ রেখে এরা দেশে ফিরলে সাথে পাকিস্তান নৌবাহিনী ছেড়ে আসা বিপুলসংখ্যক নাবিক ও নন কমিশন্ড অফিসারদের নিয়ে গঠন করা হয় ১০ সেক্টর। ভারতীয় নৌ-বাহিনীর সহায়তায় ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশী এলাকায় একটি নৌবাহিনী প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ভালো সাঁতার জানা ১৫০ জন ছাত্রকে এখানে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ১৪ আগষ্ট ১৯৭১ পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে এ সকল নৌ সেনারা শত্রদের যুদ্ধজাহাজসহ সমুদ্রগামী অনেক জাহাজ ধবংস হয়। অক্টোবর ১৯৭১ সালে অনুরূপ আরও অপারেশনে শত্রæ বাহিনীর অসংখ্য জাহাজ ধবংস করে। এর ফলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন পেশার বিভিন্ন শ্রেণীর লোকদের ভূমিকা যেমন অনেক তেমনি তরুণ টগবগে ছাত্র সমাজের ভূমিকাও কম নয়। দেশের প্রত্যেকটি আন্দোলনে এই ছাত্র সমাজ সবসময় থেকেছে সবার আগে। মুক্তিযুদ্ধেও তাদের অবদান অবিস্মরণীয়।


Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     More News Of This Category