May 18, 2024, 7:04 am

111

চীন সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়াচ্ছে তালেবানের

Spread the love

বিএসএন নিউজ: ৯/১১–র হামলায় বিরাট ধাক্কা খায় যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্ব অর্থনীতি ও নেতৃত্বের ক্ষেত্রে চালকের আসনে থাকা দেশটিতে এমন সন্ত্রাসী হামলায় বদলে যায় বৈশ্বিক চিত্রপট। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ওই হামলার প্রতিশোধ নিতে যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে যান সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে। অন্যদিকে, বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ বাড়তে শুরু করে চীনের। এরই ধারাবাহিকতায় এখন তারাই হয়ে উঠেছে আফগানিস্তানে ক্ষমতায় ফেরা তালেবানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রদের অন্যতম।

প্রথমবারের মতো তালেবানের সঙ্গে চীনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের শুরু ১৯৯৯ সালের দিকে পাকিস্তানের মধ্যস্থতায়। এর পেছনে বড় কারণ ছিল চীনের সংখ্যালঘু ও নির্যাতিত উইঘুর মুসলিমরা। আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করে উইঘুর সম্প্রদায়ের সদস্যরা যেন চীনে হামলা করতে না পারে, সে জন্য পাকিস্তানের মাধ্যমে তালেবানকে চাপ দেয় চীন। এ সময় চীনের উইঘুর–অধ্যুষিত অঞ্চল জিনজিয়াংয়ের পার্শ্ববর্তী আফগানিস্তানে উইঘুর যোদ্ধাদের ক্যাম্প বন্ধ করতেও তালেবানকে অনুরোধ করে তারা।

নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ওই সময়ের তালেবান সরকারকে বিশেষ কিছু সুবিধা দেওয়ারও ঘোষণা দেয় চীন। এর মধ্যে ছিল চীন-আফগানিস্তান সরাসরি বিমান চলাচলের মতো বিষয়। আফগানিস্তানের টেলিযোগাযোগ খাত নির্মাণে চীনের তৎকালীন টেক জায়ান্ট ‘জেটটিই’ করপোরেশন সহযোগিতা করবে—এমন প্রস্তাবও দেওয়া হয়। পাশাপাশি তালেবান সরকারের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে কাজ করবে বলেও আশা দেখায় চীন।

এরপর ২০০০ সালে প্রথমবারের মতো কোনো দেশের অমুসলিম ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে পাকিস্তানে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লু শুলিন তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন নেতা মোল্লা ওমরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এর পর থেকে পাকিস্তানের মাধ্যমে নিয়মিতই তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখে চীন।

৯/১১–র সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষাপটে আফগানিস্তানে ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। ওই হামলার জন্য দায়ী আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে ধরিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় আফগানিস্তানে অভিযান চালায় তারা। ২০০১ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বাহিনী অভিযান শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই উৎখাত হয় তালেবান সরকার। এরপর দীর্ঘ ২০ বছর তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে এসেছে তারা। এ যুদ্ধে হাজার হাজার নিরীহ আফগানের প্রাণহানি, ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়। যুদ্ধ চালিয়ে নিতে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয় যুক্তরাষ্ট্রকে। একপর্যায়ে সেই তালেবানের সঙ্গেই শান্তি আলোচনা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। তারই ধারাবাহিকতায় গত ৩১ আগস্টের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সব সেনা ফিরিয়ে নেয় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। তাদের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে আবার আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ফিরেছে কঠোরতা নিয়ে দেশ শাসন করে যাওয়া তালেবান। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে এ দুই দশকের রক্তঝরা যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের এভাবে বিদায়কে একধরনের পরাজয় হিসেবেই দেখছেন অনেক বিশ্লেষক।

আর এ সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছে বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতির নতুন খেলোয়াড় চীন। হঠাৎ আফগানিস্তানের রক্ষণশীল শাসকগোষ্ঠী তালেবানের সঙ্গে চীনের সখ্য নজর এড়ায়নি কারওই। কিন্তু এর পেছনে যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর দেশটিতে চীনের প্রভাব নতুন করে, নতুন অবয়বে শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার খাদ্য সরবরাহ, করোনাভাইরাসের টিকাসহ আফগানিস্তানকে ৩ কোটি ১০ লাখ ডলার জরুরি সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে চীন।

ভৌগোলিক নিরাপত্তা

আফগানিস্তানের সঙ্গে চীনের প্রায় ৯০ কিলোমিটারের সীমান্ত রয়েছে। আফগানিস্তানের সীমান্তের ওপাশেই উইঘুর মুসলিম–অধ্যুষিত চীনের জিনজিয়াং প্রদেশ। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে উইঘুরদের ওপর চীনের ধরপাকড় ও ব্যাপক নির্যাতন চালানোর অভিযোগ করে আসছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রদেশটির অন্তত ২০ লাখ সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমকে জোর করে বন্দিশিবিরে রাখা হয়েছে। এসবের প্রমাণও মিলেছে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে।

তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় এসে বিরোধপূর্ণ কাশ্মীরের মুসলিমদের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। তারা উইঘুরদের পাশেও দাঁড়ানোর ঘোষণা দিতে পারে—এমন ভয় রয়েছে চীনের। আর সেটা করলে জিনজিয়াং প্রদেশে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ তৎপরতা বেড়ে যেতে পারে, যা চীনের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।

গত জুলাই মাসে তালেবানের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল চীন সফর করেছে। সেখানে তারা চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এ সময় ওয়াং তালেবানকে ‘আফগানিস্তানের একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি’ হিসেবে অভিহিত করেন। এ ছাড়া আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার আশ্বাস দেন ওয়াং।

এ সময় তালেবান প্রতিনিধিদলও চীনকে ‘ভালো বন্ধু’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। তালেবানের পক্ষ থেকে এ-ও বলা হয়, আফগানিস্তানের ভূখণ্ড ব্যবহার করে চীনবিরোধী কোনো কাজ করতে দেওয়া হবে না। বৈঠকের পর তালেবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ চীনা সম্প্রচারমাধ্যম সিজিটিএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘চীন আমাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী প্রতিবেশী দেশ। অতীতেও তাদের সঙ্গে আমাদের ইতিবাচক সম্পর্ক ছিল। আমরা এ সম্পর্ক আরও জোরদার করতে চাই।’

ভূরাজনীতি

চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্পে আফগানিস্তানকে দীর্ঘদিন ধরেই যুক্ত করতে চেয়েছে বেইজিং। বর্তমান প্রেক্ষাপট চীনের সেই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের মোক্ষম সুযোগ করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের র‌্যান্ড করপোরেশনের একজন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক লিখেছেন, চীন নীরবে আফগানিস্তানে তার স্বার্থ রক্ষায় তৎপরতা শুরু করেছে।

তবে চীনের এ তৎপরতা নতুন কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্রের আশীর্বাদপুষ্ট আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সরকারের (সদ্য ক্ষমতাচ্যুত) কাছেও গিয়েছে চীন। তবে তাদের নানা প্রস্তাবে আশরাফ গনি সরকার রাজি হয়নি এ ভেবে যে তাতে যুক্তরাষ্ট্র নাখোশ হবে। এ ছাড়া আশরাফ গনি সরকারের সময় দেশটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে ভারতের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখ করার মতো। আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভবনের নির্মাণকাজসহ বিভিন্ন প্রকল্পে বিপুল অঙ্কের অর্থসহায়তা ও বিনিয়োগ করেছে ভারত। আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক থাকায় এত দিন আফগানিস্তানে প্রকাশ্য হস্তক্ষেপ করতে পারেনি চীন। অন্যদিকে, তালেবানের সঙ্গে ভারতের সখ্য শূন্যের কোঠায়। এ সুযোগও কাজে লাগাতে চাইছে চীন। আর এ কাজে চীনের সহযোগী হচ্ছে ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবেশী পাকিস্তান।

এরই মধ্যে চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডরে আফগানিস্তানকে যুক্ত করতে চাইছে বেইজিং। এ জন্য পেশোয়ার ও কাবুলের মধ্যে একটি মহাসড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে কাবুলের সঙ্গে দুই বছর ধরে আলোচনাও করছে চীন। যুক্তরাষ্ট্র নাখোশ হবে ভেবে আশরাফ গনি সরকার চীনের সেই প্রস্তাবে রাজি না হলেও তালেবান ক্ষমতায় আসায় বেইজিংয়ের সেই পথের কাঁটা দূর হয়েছে। এ জন্যও তালেবান সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তে চাইছে চীন।

খনিজ সম্পদ

২০১০ সালে মার্কিন সেনাবাহিনী ও ভূতাত্ত্বিকেরা ঘোষণা দেন, আফগানিস্তানে খনিজ সম্পদের বিপুল ভান্ডার রয়েছে। দেশটির দুর্গম প্রদেশগুলোয় লোহা, তামা, সোনা ছাড়াও রয়েছে একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক প্রযুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় নানা মূল্যবান খনিজ পদার্থ। এসব খনিজ স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, এলইডি স্ক্রিন শিল্পের জন্য জরুরি।

এর মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান লিথিয়াম। বলা হচ্ছে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় লিথিয়ামখনি আফগানিস্তানে। আর এই লিথিয়াম রিচার্জেবল ব্যাটারি তৈরির একটি মূল উপাদান। জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় বর্তমানে এর চাহিদা আকাশ ছুঁয়েছে। আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদের মূল্য এক ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি হতে পারে বলে ধারণা করা হয়।

কিন্তু এসব খনিজ সম্পদ উত্তোলনের সক্ষমতা বা প্রযুক্তি—কোনোটিই তালেবানের নেই। এ সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে পারে চীন। আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া গেলে চিপ তৈরির ক্ষেত্রে চীন বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী দেশে পরিণত হবে বলে ধারণা করা হয়।


Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     More News Of This Category