ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়েও বাংলাদেশের দুশ্চিন্তার কিছু নেই বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক শুধু একটি দলের ওপর নির্ভর করে না; বাণিজ্যিক, কৌশলগত, ভূরাজনৈতিকসহ অনেক বিষয় এখানে রয়েছে। তবে কূটনীতিকদের মতে, সরকার যে সংস্কারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাতে মার্কিন সহায়তার যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তার ওপরেও প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন উপলক্ষে গতকাল বুধবার দূতাবাসের আয়োজনে ঢাকার আমেরিকান সেন্টারে আয়োজিত নির্বাচন পর্যবেক্ষণের বিশেষ আয়োজনে বাংলাদেশের তরুণ নেতা, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের সদস্যরা অংশ নেন।
এতে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে শ্বেতপত্র তৈরির দায়িত্ব পাওয়া কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বর্তমান বিশ্বে যে জটিল পরিস্থিতি রয়েছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের ফলাফল আরও সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখবে। বাংলাদেশের মানুষ অনেক দিন বিভিন্ন কারণে ভোট দিতে পারেনি। তাই অন্য দেশের ভোটের অভিজ্ঞতা থেকে নিজেদের জন্য আমরা বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে চাই। কীভাবে সাবলীল পরিস্থিতিতে একটি নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হয়; নির্বাচন ব্যবস্থা যারা দেখভাল করেন তারা কী রকম আচরণ করেন এবং নির্বাচনের ফল পেয়ে তারা কীভাবে তা গ্রহণ করেন– সব বিষয়েই আমাদের শেখার আছে।
একই অনুষ্ঠানে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যদিও ট্রাম্প একটা টুইট করেছেন এবং এটি তাঁর ভোটের বিবেচনায় ভারতীয়দের ভোট পাওয়ার জন্য করেছেন। আমি নিশ্চিত– বাংলাদেশ কোথায়, সেটাও ট্রাম্প জানেন না।
আমার মনে হয় না এটার কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রও শঙ্কার মধ্যে আছে, ভয়াবহ সংকটের মধ্যে আছে। তাদের মধ্যে যে বিভাজন, সেটা ভয়ানক। এবার কী হবে, সেটা নিয়ে অনেকে শঙ্কিত।
যুক্তরাষ্ট্র অব্যাহতভাবে ২৫০ বছরের বেশি সময় ধরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কার্যকারিতা প্রদর্শন করেছে জানিয়ে বদিউল আলম বলেন, তাদের আর আমাদের পদ্ধতি ভিন্ন। আমাদের সংসদীয় ব্যবস্থা দুর্ভাগ্যবশত স্থিতিশীল হয়নি। অনেক টালমাটাল অবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা গেছি। অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে আমরা গিয়েছি।
সদ্য ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় গেলে দলটির সুদিন ফিরবে। ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের মধ্য পালিয়ে যাওয়া দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে ‘চট করে’ বাংলাদেশে চলে আসবেন। আর এটি এখন অফিস-আদালত থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে আলোচনার অন্যতম বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে আলোচনার ডালপালা গজিয়েছে যখন ট্রাম্প বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর মন্তব্য প্রকাশ করেন। বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিষ্টান, অন্য সংখ্যালঘুর ওপর ‘বর্বর’ সহিংসতা চালানো হচ্ছে এবং তারা হামলা ও লুটপাটের শিকার হচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক এই প্রেসিডেন্ট এক্সে লেখেন, ‘এটা আমার নজরদারিতে থাকলে ঘটত না। কমলা এবং জো সারাবিশ্বে এবং আমেরিকায় হিন্দুদের উপেক্ষা করেছে। তারা ইসরায়েল থেকে ইউক্রেন এমনকি আমাদের দক্ষিণ সীমান্ত পর্যন্ত বিপর্যয় এনেছে। কিন্তু আমরা আমেরিকাকে আবার শক্তিশালী করব এবং শক্তির মাধ্যমে শান্তি ফিরিয়ে আনব।’
ভারতের নরেন্দ্র মোদিকে বন্ধু উল্লেখ করে তিনি লেখেন, ‘আমরা হিন্দু আমেরিকানদেরও কট্টরপন্থি বামপন্থিদের ধর্মবিরোধী এজেন্ডা থেকে রক্ষা করব। আমরা আপনার স্বাধীনতার জন্য লড়াই করব।’
কূটনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি কোনো একক ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে খুঁটিনাটি আলোচনার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পনা করে নীতি তৈরি করে দেশটি।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক বলেন, ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার কারণে অবৈধ অভিবাসীরা বিপাকে পড়তে পারেন, যা কিছু ক্ষেত্রে সেখানে অবৈধভাবে থাকা বাংলাদেশিরা আক্রান্ত হবেন। এ ছাড়া রোহিঙ্গাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে বাংলাদেশে অর্থায়ন আক্রান্ত হতে পারে। জাতিসংঘে বাজেটে প্রভাব পড়তে পারে। ফলে শান্তিরক্ষীদের বেতন প্রভাবিত হবে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, জঙ্গিবাদ দমন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে অর্থায়নের মতো বিষয়গুলোতে প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাতে মার্কিন সহায়তার যেসব প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তার ওপরেও প্রভাব পড়তে পারে।