বিদায়ী অর্থবছর বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে ২৮ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকা। যদিও এর মধ্যে কয়লাভিত্তিক পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জই ছিল ১৬ হাজার ৭৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ক্যাপাসিটি চার্জের ৫৬ শতাংশের বেশিই গেছে এ পাঁচ বিদ্যুৎকেন্দ্রের পেছনে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে গেছে ভারতের আদানি পাওয়ার।
যদিও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য বলছে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কোনোটিরই সক্ষমতার পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার হয়নি। সাধারণত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতার ৮০ শতাংশ ব্যবহারের শর্তে লাইসেন্স দেয়া হয়। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছর কয়লাভিত্তিক পাঁচটি কেন্দ্রের মধ্যে সবচেয়ে চলেছে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি, সক্ষমতার ৬৯ শতাংশ। তবে উৎপাদন সক্ষমতা বেশি হওয়ায় সর্বোচ্চ ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে আদানি পাওয়ার।
পিডিবির তথ্যমতে, বর্তমানে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ আসে ভারতের আদানি পাওয়ারের ঝাড়খণ্ডের গড্ডা কেন্দ্রটি থেকে। এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট এ কেন্দ্রটির সক্ষমতার ৬২ শতাংশ ব্যবহার হয়েছে গত অর্থবছর। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ৮১৬ কোটি ৬৭ লাখ ইউনিট। যদিও সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার হলে কেন্দ্রটিতে উৎপাদন করা যেত এক হাজার ৩১০ কোটি ৫০ লাখ ইউনিট। সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার না হলেও ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে পুরোটার জন্যই। এতে পিডিবির খরচ করতে হয়েছে পাঁচ হাজার ৮২৩ কোটি ৭১ লাখ টাকা, যা মোট ক্যাপাসিটি চার্জের ২০ দশমিক ৩০ শতাংশ।
এদিকে বর্তমানে দেশের ভেতর নির্মিত সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র পটুয়াখালীর পায়রা। বাংলাদেশ-চীন যৌথ উদ্যোগে নির্মিত এ কেন্দ্রটির সক্ষমতা এক হাজার ২৪৪ মেগাওয়াট। গত অর্থবছর এ সক্ষমতার ৬৯ শতাংশ ব্যবহার হয়। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ৭৫৪ কোটি ৮৭ লাখ ইউনিট। যদিও সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার হলে কেন্দ্রটিতে উৎপাদন করা যেত এক হাজার ১৫৬ কোটি ৩২ লাখ ইউনিট। সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার না হলেও ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয় চার হাজার ৩৪০ কোটি ৯২ টাকা, যা মোট ক্যাপাসিটি চার্জের ১৫ দশমিক ১৩ শতাংশ।
এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন এসএস পাওয়ার দেশের তৃতীয় বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র। চীনের সেপকো থ্রির সঙ্গে যৌথভাবে নির্মিত এ কেন্দ্রটির উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ২০৪ মেগাওয়াট, গত অর্থবছর যার মাত্র ২৩ শতাংশ ব্যবহার হয়েছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে মাত্র ২৪০ কোটি ৯ লাখ ইউনিট। মূলত কয়লা সংকট ও জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে সংযোগ সঞ্চালন লাইন নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় এটি বছরের বেশিরভাগ সময় বসে ছিল।
সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার হলে কেন্দ্রটিতে উৎপাদন করা যেত এক হাজার ১০০ কোটি ইউনিট। তবে সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার না হলেও ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে পুরো সক্ষমতার। এর পরিমাণ ছিল তিন হাজার ২৮৭ কোটি ৬৬ লাখ টাকা, যা ক্যাপাসিটি চার্জ খাতে মোট ব্যয়ের ১১ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরে দ্বিতীয় বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র বাগেরহাটের রামপাল। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ মালিকানায় নির্মিত এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ২৩৪ মেগাওয়াট। গত অর্থবছর এ সক্ষমতার ২৯ শতাংশ ব্যবহার হয়েছে। কারিগরি ত্রুটির কারণে এর একটি ইউনিট বছরের বেশিরভাগ সময় বন্ধই ছিল। কয়লা সংকটে বাকি ইউনিটটিও পূর্ণ সক্ষমতায় চলতে পারেনি।
কেন্দ্রটিতে গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে মাত্র ৩১৩ কোটি ৩৩ লাখ ইউনিট। যদিও সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার হলে কেন্দ্রটিতে উৎপাদন করা যেত এক হাজার ১৫০ কোটি ইউনিট। কারিগরি ত্রুটির কারণে লম্বা সময় একটি ইউনিট বন্ধ থাকায় সক্ষমতা অনুপাতে কেন্দ্রটির জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়নি। এতে তুলনামূলক কম ব্যয় হয়েছে, যার পরিমাণ ছিল এক হাজার ৯০৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।
এদিকে কয়লাভিত্তিক তুলনামূলক ছোট একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে পটুয়াখালীতে। বরিশাল ইলেকট্রিক নামক এ কেন্দ্রটির সক্ষমতা ৩০৭ মেগাওয়াট, যার ৪৬ শতাংশ ব্যবহার করা হয়েছে। কেন্দ্রটিতে গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১২৫ কোটি এক লাখ ইউনিট। যদিও সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার হলে কেন্দ্রটিতে উৎপাদন করা যেত ২৬৮ কোটি ৯৩ লাখ ইউনিট। কয়লা সংকটে এটি বছরের লম্বা একটি সময় বন্ধ ছিল। তবে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে পুরো সক্ষমতার, যার পরিমাণ ৭১৬ কোটি আট লাখ টাকা।
পিডিবির কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, মূলত কয়লা সংকটে আদানি ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতার পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার করা যায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে বারবার চিঠি দিয়েও কয়লা আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় ডলার পায়নি। ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বসে থাকার পরও পিডিবির পূর্ণ সক্ষমতার ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে। এতে সরকারের গচ্চা গেছে কয়েক হাজার কোটি টাকা।
পিডিবির ১৫ বছরের হিসাব বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৯-১০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ১৫ বছরে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল ও আইপিপিগুলোর (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) জন্য পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়েছে প্রায় এক লাখ ৩৪ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। যদিও এ সময় কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রেরই সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার হয়নি। এমনকি কোনো কোনো বছর সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার হয়নি। বসিয়ে রেখেই প্রতি বছরই ক্যাপাসিটি চার্জের পুরোটা পরিশোধ করা হয়।
পিডিবির তথ্য বলছে, ২০০৯-১০ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত ১০ বছরে ৫০ হাজার ৫৪৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে। তবে শেষ পাঁচ বছরে (২০১৯-২০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর) এ খাতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৪ হাজার ৫৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ শেষ পাঁচ বছরে আগের ১০ বছরের তুলনায় ৬৬ শতাংশ বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে পিডিবিকে।