২০১৯ সালে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান বেস্ট হোল্ডিংসে ১ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকসহ পাঁচ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ম লঙ্ঘন করে তাদের সহযোগিতা করেছে। রাজনৈতিক চাপের এই বিনিয়োগে ব্যাংকগুলো জনগণের আমানত থেকে ১ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা লোকসান করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনসহ একাধিক রাষ্ট্রীয় সংস্থার প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেস্ট হোল্ডিংসে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক ৫০০ কোটি, জনতা ব্যাংক ৫০০ কোটি, অগ্রণী ব্যাংক ৩৭৫ কোটি, রূপালী ব্যাংক ৩০০ কোটি ও বেসরকারি খাতের এনসিসি ব্যাংক বিনিয়োগ করে ১০০ কোটি টাকা। এসব অর্থ দিয়ে ব্যাংকগুলো মোট ২৭ কোটি ৩০ লাখ ৭৭ হাজার শেয়ার ক্রয় করে। এতে ১ হাজার ২৩৮ কোটি টাকার লোকসান গুনেছে এসব ব্যাংক, যা জনগণের আমানতের অপচয়।
তথ্য বলছে, পদ্মা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী নাফিস সারাফাত প্রভাব খাটিয়ে এসব বিনিয়োগ বের করে নিয়েছেন। ব্যাংকগুলো ক্ষতি জেনেও বেস্ট হোল্ডিংসে বিনিয়োগে বাধ্য হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর সূত্র। আর এ ক্ষেত্রে সহায়তা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকে বিনিয়োগের বিষয়ে অবহিত করে চিঠি পাঠানোর পর তড়িঘড়ি করে এসব বিনিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয়। ফলে ঝুঁকিতে পড়ে সাধারণ মানুষের আমানত।
তথ্য বলছে, বেস্ট হোল্ডিংসে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম সরকারি ব্যাংক হিসেবে বিনিয়োগ করে রূপালী ব্যাংক। প্রাইভেট প্লেসমেন্ট শেয়ারে প্রজেক্ট এসপিভির মাধ্যমে প্রতি শেয়ার ৫৫ টাকা প্রিমিয়ামসহ ৬৫ টাকা দরে মোট ৪ কোটি ৬১ লাখ ৫৩ হাজার ৮৫০টি শেয়ার ক্রয় করা হয়। এজন্য প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে ৩০০ কোটি টাকা অনুমোদন করে রূপালী ব্যাংক। ওই সময় ব্যাংকটি ৬৫ টাকা দরে শেয়ার ক্রয় করলেও বর্তমানে এই শেয়ারের দর নেমে এসেছে ১৯ টাকা ৮০ পয়সায়। এতে রূপালী ব্যাংকের লোকসান গুনতে হচ্ছে প্রায় ২০৯ কোটি টাকা।
২০১৯ সালে জুনভিত্তিক প্রকাশিত বেস্ট হোল্ডিংসের আর্থিক হিসাব পর্যালোচনায় দেখা যায়, ওই সময় প্রতিষ্ঠানটির অনুমোদিত মূলধন ছিল ১ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু পরিশোধিত মূলধন ছিল মাত্র ৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। একই সময় প্রতিষ্ঠানটির দায় ছিল ২ হাজার ৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের ফাইন্যান্সিয়াল লেভারেজ অত্যন্ত বেশি এবং ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ব্যাংকের আমানতকে ঝুঁকি তৈরি করেছে রূপালী ব্যাংক। বেস্ট হোল্ডিংসে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি সার্কুলার-১৫ এর নির্দেশনা অমান্য করেছে রূপালী ব্যাংক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রূপালী ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক পারসুমা আলমকে একাধিকবার ফোন দিয়েও পাওয়া যায়নি।
তথ্য বলছে, ২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ৬৬২তম সভায় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান বেস্ট হোল্ডিংসের অনুকূলে শেয়ার ক্রয়ের সিদ্ধান্ত হয়। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রাইভেট প্লেসমেন্ট শেয়ারে প্রজেক্ট এসপিভির মাধ্যমে প্রতি শেয়ার ৫৫ টাকা প্রিমিয়ামসহ ৬৫ টাকা দরে মোট ৭ কোটি ৬৯ লাখ ২৩ হাজার ১০০টি শেয়ার ক্রয় করা হয়। এজন্য একই মাসের ১৫ তারিখে প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে ৫০০ কোটি টাকা অনুমোদন করে সোনালী ব্যাংক। ওই সময় ব্যাংকটি ৬৫ টাকা দরে শেয়ার ক্রয় করলেও বর্তমানে এই শেয়ারের দর নেমে এসেছে ১৯ টাকা ৮০ পয়সায়। এতে সোনালী ব্যাংকের লোকসান গুনতে হচ্ছে ৩৪৮ কোটি টাকা।
বেস্ট হোল্ডিংসের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের কাছে ১৫ কোটি ৮৬ লাখ শেয়ার এবং অবশিষ্ট ২৬ কোটি ৩৩ লাখ শেয়ার অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে বিক্রয় করা হয়। কিন্তু দুর্বল আর্থিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানে অভিহিত মূল্যের অতিরিক্ত ৫৫ টাকা করে প্রিমিয়াম প্রদানপূর্বক প্লেসমেন্ট শেয়ারে বিনিয়োগ করায় ব্যাংকের ৪২৩ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এর পরও বেস্ট হোল্ডিংসে বিনিয়োগের পূর্বে সার্বিক বিষয় উল্লেখ করে ৫৫ টাকা প্রিমিয়ামসহ ৬৫ টাকা দরে ক্রয়ের অনুমতির জন্য অনাপত্তি পত্র চাওয়া হলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনাপত্তি পত্র প্রদান করা হয়েছে। ফলে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও অনাপত্তি প্রদান করায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক তার দায় এড়াতে পারে না।
তথ্য বলছে, ২০১৭ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত সোনালী ব্যাংকের ৫০৯তম সভায় বেস্ট হোল্ডিংসে বিনিয়োগের বিষয়ে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার ঋণ প্রস্তাব উঠেছিল। কিন্তু সে সময় পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা প্রস্তাবটি অনুমোদনে অসম্মতি জানান। এ ক্ষেত্রে তৎকালীন বোর্ড প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে কয়েকটি পর্যবেক্ষণ দিয়ে প্রস্তাব নাকচ করে দেয়।
ওই পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বেস্ট হোল্ডিংসের সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি লাভজনক নয়। প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন অনুমোদিত মূলধন ছিল ৬০০ কোটি টাকা। আর পরিশোধিত মূলধন ছিল মাত্র ১ কোটি ৮ লাখ টাকা। এত কম মূলধনের বিপরীতে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার বন্ড ইস্যু অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এ ছাড়া ইক্যুইটি অংশগ্রহণও নগণ্য। বেস্ট হোল্ডিংসের হোটেল লা মেরিডিয়ানে ২০১৬ সালের জুনভিত্তিক হিসাবে পুনর্মূল্যায়ন রিজার্ভ ১ হাজার ৬২২ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির ইক্যুইটিতে পুনর্মূল্যায়ন রিজার্ভ বিবেচনায় না আনলে ঋণাত্মক রিটেইনড আর্নিংসহ ইক্যুইটি ঋণাত্মক। অন্যদিকে, তাদের ঋণ অনেক বেশি। হোটেল লা মেরিডিয়েনের সম্পদের পরিমাণ ১ হাজার ১২৬ কোটি টাকা। ওই সময় ব্যাংককে বলা হয়, হোটেলের আয়ের প্রবাহ দ্বারা ইস্যু করা বন্ড ও বন্ডের সুদ পরিশোধ করা হবে। কিন্তু ঋতু পরিবর্তন বা রাজনৈতিক অবস্থা পরিবর্তন হলে হোটেল ব্যবসা ঝুঁকিপূর্ণ খাত হিসেবে বিবেচ্য বলে উল্লেখ করে সোনালী ব্যাংকের বোর্ড।
পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, প্রস্তাবিত মর্টগেজ করা সম্পত্তি রাজউকের লিজহোল্ড প্রোপার্টি, যা বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির কাছে সিন্ডিকেট ঋণের বিপরীতে মর্টগেজকৃত। এমন অবস্থায় প্রস্তাবিত বন্ডে বিনিয়োগ করা অর্থ প্রাপ্তির পর ওই মর্টগেজ পে-অফ করে রাজউকের অনুমতি সাপেক্ষে তা বন্ডের বিপরীতে ১৮০ দিনের মধ্যে রি-মর্টগেজ করার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
শুধু তাই নয়, ২০১৬ সালের জুনভিত্তিক হিসাবে প্রতিষ্ঠানটির নিট ব্যয়-পরবর্তী ক্ষতি ৭৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকা এবং রিটেইন আর্নিং ৪৪ কোটি টাকা ঋণাত্মক। কিন্তু নতুন আবেদনে ক্ষতির পরিবর্তে ২ কোটি ১৭ টাকা লাভ, রিটেইন আর্নিং ৩৬ কোটি টাকা ধনাত্মক উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনকে অতিরঞ্জিত করে কোম্পানির আর্থিক অবস্থা ভালো দেখানো হয়েছে।
আর ২০১৯ সালের জুনভিত্তিক হিসাবে স্থিতিভিত্তিক মোট পুনর্মূল্যায়ন রিজার্ভের পরিমাণ ১ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির ইক্যুইটি পুনর্মূল্যায়ন রিজার্ভ বিবেচনায় না আনলে ঋণের হার ১৯৬ শতাংশ, যা বিনিয়োগ অনুকূল নয়। পুনর্মূল্যায়ন রিজার্ভ বিবেচনায় না আনলে শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ মূল্য দাঁড়ায় ২৫ দশমিক ৪৩ টাকা। ফলে প্রতি শেয়ারে ৬৫ টাকা করে বিনিয়োগের যৌক্তিকতা নেই।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শওকত আলী কালবেলাকে বলেন, ওই সময় কেন এই বিনিয়োগ করা হয়েছে জানা নেই। এতে ব্যাংকের লোকসান গুনতে হচ্ছে। এই লোকসান কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, সে বিষয়ে কাজ করবে সোনালী ব্যাংক।
সোনালী ব্যাংকের সমপরিমাণ ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে জনতা ব্যাংকও। একইভাবে প্রভাব খাটিয়ে এসব ঋণ অনুমোদন করা হয়েছিল। বর্তমানে ব্যাংকটিকেও এসব ঋণের ৩৪৮ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, আমি মাত্রই এখানে দায়িত্ব নিয়েছি। এখনো সব তথ্য আমার কাছে নেই। বোর্ড সভা থাকায় তিনি প্রতিবেদকের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করতে পারেননি।
ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আনোয়ারুল ইসলাম ব্যাংকটির ট্রেজারি বিভাগের প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। ট্রেজারি প্রধান মোখলেসুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ওই সময় প্রতিষ্ঠানটি তাদের অডিটেড ভেল্যু দেখিয়ে শেয়ারের মূল্য নির্ধারণ করেছিল ৮৫ টাকা। কিন্তু ব্যাংক সার্বিক বিষয় বিবেচনায় তা কমিয়ে ৬৫ টাকায় বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারদর কমে যায়। এতে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে ব্যাংককে। তবে লোকসান কমাতে ব্যাংক কাজ করছে বলেও জানান তিনি।
এ ছাড়া একমাত্র বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে ২০১৯ সালে বেস্ট হোল্ডিংসে বিনিয়োগ করেছিল এনসিসি ব্যাংক। ব্যাংকটির প্রায় শতকোটি টাকা লোকসানের বিষয়ে জানতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক সামসুল আরেফিনকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
তথ্য বলছে, বেস্ট হোল্ডিংসে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর অনুকূলে সব সম্পত্তির ওপর চার্জ সৃষ্টি করার কথা ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। এমনকি বিনিয়োগের ওপর ১০ শতাংশ হারে সুদ আদায় করার কথা থাকলেও তা আদায় হয়নি, যা আইনের লঙ্ঘন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আর শিখা কালবেলাকে বলেন, এসব বিনিয়োগে ব্যাংকগুলো কোনো অনিয়ম করেছে কি না, সেটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক খতিয়ে দেখবে। যদি অনিয়ম হয়ে থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সুত্র: কালবেলা