সরকার ফোনে কেন আড়িপাততে চায়?


Md. Hasib Uddin প্রকাশের সময় : জানুয়ারী ১৫, ২০২৩, ১২:০৩ অপরাহ্ন / ৭৫
সরকার ফোনে কেন আড়িপাততে চায়?
Spread the love

বাংলাদেশে ফোনে আড়িপাতা নিয়ে বিতর্ক চলছে অনেক দিন ধরেই৷ সম্প্রতি সরকার বিরোধীদের ফোন কলের রেকর্ড বারবার ফাঁস হওয়ার পর অনেকের ধারণা যে, ফোনে আড়িপাতা হচ্ছে৷

ফোনে আড়িপাতার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকেও স্পষ্ট বক্তব্য দেওয়া হয়েছে৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গত ১২ জানুয়ারি  সংসদে বলে, ‘‘আইনসম্মতভাবে আড়িপাতার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার৷’’

কিন্তু প্রশ্ন হলো, নাগরিকদের ফোনে আড়িপাতার বিষয়টিকে দেশের সংবিধান এবং আইন কতটা সমর্থন করে?

একবার দেখে নেওয়া যাক এ বিষয়ে কী বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শফিউল ইসলামের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মনিটরিংয়ের (নজরদারি) মাধ্যমে দেশ ও সরকারবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম বন্ধে এনটিএমসিতে (ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার) ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স টেকনোলজির (ওএসআইএনটি) মতো আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজিত হয়েছে৷ একই সঙ্গে একটি ইন্টিগ্রেটেড ল’ফুল ইন্টারসেপশন সিস্টেম (আইনসম্মতভাবে মুঠোফোন ও ইন্টারনেট মাধ্যমে যোগাযোগে আড়ি পাতার ব্যবস্থা) চালু করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷’’

অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় স্পষ্ট নয় যে, আড়িপাতার জন্য নতুন আইন করা হবে নাকি প্রচলিত ব্যবস্থায়ই আড়িপাতা বাড়ানো হবে৷

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশেষ পরিস্থিতিতে আদালতের অনুমতি ছাড়া যেকোনোভাবে আড়িপাতা সংবিধান ও আইনবিরোধী৷ দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী৷ তারা মনে করেন, আড়িপাতার জন্য আইন করার কোনো সুযোগ নেই৷ যদি সেটা করা তাহলে এটি হবে সংবিধান ও গণবিরোধী কাজ৷

আইন যা বলছে

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ৯৭ (ক)(১) ধারা বলছে, ‘‘এ আইনে বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যা কিছুই থাকুক না কেন রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে যেকোনো টেলিযোগাযোগ সেবা ব্যবহারকারীর প্রেরিত বার্তা ও কথোপকথন প্রতিহত, রেকর্ড ধারণ বা তৎসম্পর্কিত তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য সরকার সময় সময় নির্ধারিত সময়ের জন্য গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কোনো কর্মকর্তাকে ক্ষমতা প্রদান করতে পারবে এবং উক্ত কাজে সার্বিক সহায়তা দেয়ার জন্য টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানকারীকে নির্দেশ দিতে পারবে এবং পরিচালনাকারী উক্ত নির্দেশ পালন করতে বাধ্য থাকবে৷’’

এই ধারার উপধারা ২-এ বলা হয়েছে, এই ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে ‘সরকার’ বলতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বুঝাবে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে এই ধারার বিধান প্রয়োগযোগ্য হবে৷

তাই বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলার প্রয়োজনে আড়িপাতার মতো কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে৷

তবে এই আইনের ৭১ ধারা বলছে,

‘‘কোনো ব্যক্তি যদি অপর দুইজন ব্যক্তির টেলিফোন আলাপে ইচ্ছাকৃতভাবে আড়ি পাতেন, তাহলে প্রথমোক্ত ব্যক্তির, এ কাজ হবে একটি অপরাধ এবং সেজন্য তিনি অনধিক দুই বছর কারাদণ্ডে অথবা অনধিক পাঁচ কোটি  টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷” শর্ত থাকে যে, ধারা ৯৭(ক)-এর অধীন সরকার থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কোন কর্মকর্তার ক্ষেত্রে এই ধারা প্রযোজ্য হবে না৷

তবে কোনো আইনেই ফোন কল রেকর্ড প্রকাশের কোনো বিধান নাই৷ এটা করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ কিন্তু এটা যদি ক্ষমতাপ্রাপ্তরা প্রকাশ করেন তাহলে কী শাস্তি হবে তা আইনে বলা নেই৷

সংবিধান কী বলছে

সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে নাগরিকদের ব্যক্তিগত ও অন্যান্য যোগাযোগের ক্ষেত্রে গোপনীয়তার অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে৷ ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-

রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের (ক) প্রবেশ, তল্লাশী ও আটক হতে স্বীয় গৃহে নিরাপত্তালাভের অধিকার থাকবে; এবং (খ) চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকবে৷

এদিকে ২০২১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ফোনালাপ ফাঁস ও নজরদারি প্রসঙ্গে এক রিটের শুনানিতে হাইকোর্ট বলেন, ব্যক্তিগত বিষয়গুলোতে আড়ি পাতা যেমন ঠিক নয়, তেমনি মিডিয়া সগৌরবে সেগুলো প্রচার করে এটিও ঠিক নয়৷

‘আড়িপাতার সুযোগ নেই’

বিশ্লেষকরা বলছেন, সংবিধান ও টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে এটা স্পষ্ট যে গণভাবে আড়ি পাতার কোনো সুযোগ নেই৷ আর টেলিযোগাযোগ আইনের ওই ধরাটি করা হয়েছিলো জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের জন্য৷ আদালতের অনুমতি নিয়ে আড়িপাতা যায়৷ এর বাইরে সুযোগ নেই৷ নতুন কোনো আইনেরও প্রয়োজন নেই৷ আর সেই ধরনের আইন করলে তা সংবিধানবিরোধী হবে৷

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘‘আইন নেই তারপরও আড়ি পাতা হচ্ছে৷ আবার কল রেকর্ড ফাঁসও হচ্ছে৷ তাহলে কাজ যা করার তা চলছে৷ আগে সরকার এটা অস্বীকার করত৷ কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে যা বলেছেন তার মাধ্যমে স্বীকার করলেন যে তারা আড়ি পাতছেন৷’’

তার কথা, ‘‘এর মধ্য দিয়ে নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার লংঙ্ঘন করা হচ্ছে৷ আর এর মাধ্যমে বিরোধী দলের নেতাদের কল রেকর্ড ফাঁস হচ্ছে৷ কিন্তু সরকারি লোকজনও শেষ পর্যন্ত এর বাইরে থাকবে না৷ কয়েকটি ঘটনা তো আমরা দেখেছি৷’’

সংবিধান বিশেজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘‘বিশেষ ক্ষেত্রে যেমন, জঙ্গিবাদ বা টেররিস্ট অ্যাক্টিভিটিজের ক্ষেত্রে যদি আগাম তথ্যের প্রয়োজন হয় তাহলে গণতান্ত্রিক দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আদালতে আবেদন করে এবং আদালত অনুমতি দিলে তারা টেলিফোন রেকর্ড বা আড়ি পাততে পারে৷ আর এটা হয় কেস টু কেস৷ কিন্তু আমাদের দেশে আইনের শাসন দুর্বল, গণতন্ত্রও দুর্বল তাই আশঙ্কা হয় যে, সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনিকে ঢালাওভাবে আড়ি পাতার ক্ষমতা দিতে পারে৷ এটা হলে আমাদের যতটুকু মৌলিক অধিকার ধুকতে ধুকতে আছে তাও হুমকির মুখে পড়বে৷’

তার কথা, ‘‘আমাদের দেশে এই ধরনের আইন করা হয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে৷ ব্ল্যাকমেইল করার জন্যও এটার অপপ্রয়োগ হতে পারে ৷এটা অপপ্রয়োগ হতে বাধ্য৷’’

‘‘আমাদের দেশে দেখি কল রেকর্ড আবার ফাঁস হয়৷ টেলিভিশন চানেলগুলো তা আবার প্রচার করে৷ এগুলো কারা করে? উন্নত গণতান্ত্রিক দেশ হলে এর বিরুদ্ধে মানহানি ও ক্ষতিপুরণের মামলা করা যেত৷ কিন্তু আমাদের দেশে কেউ সাহস পায় না,’’ বলেন এই সংবিধান বিশেষজ্ঞ৷

আড়িপাতার উদ্দেশ্য কী

বাক স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা আর্টিক্যাল ১৯-এর দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ফারুক ফয়সাল বলেন, ‘‘নির্বাচন যখন সামনে আসে তখন সরকার একটু দুর্বল চিত্ত হয়৷  ২০২৪ সালে নির্বাচন হবে৷ আমার ধারণা সরকার দুশ্চিন্তায় আছে৷ দেশের প্রত্যেক নাগরিকের ব্যক্তিগত গোগনীয়তার অধিকার আছে৷ আমরা এই ধরনের আইনের বিরুদ্ধে৷ আমরা আড়ি পাতার বিরুদ্ধে৷ আমরা এর প্রতিবাদ জানাই৷’’

তার কথা, ‘‘ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা ও সংহত করার জন্যই ক্ষমতাসীনরা এই ধরনের আইন করে৷’’

মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক নূর খান মনে করেন, ‘‘সরকার যখন কতৃত্ববাদী হয়ে যায়, যখন জবাবদিহিতার প্রয়োজন মনে করে না তখনই শুধু এই ধরনের আইন করার চিন্তা করতে পারে৷ তারা ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার জন্য এটা করে৷ তারা জনগনকে যখন ক্ষমতার উৎস মনে করে না তখনই এই ধরনের আইন করে৷’’

তার কথা, ‘‘আমরা দেখেছি টেলিফোন রেকর্ড ফাঁস করে অপবাদ দেয়া হয়, জনসমক্ষে কাউকে হেয় করা হয়৷ এটা দুর্ভাগ্যজনক৷ এর সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষ কোনোভাবেই জড়িত না, বরং দেশের মানুষ মনে করে এর সঙ্গে বিভিন্ন সংস্থা যুক্ত৷’’

‘‘দেশে কোনো যুদ্ধাবস্থা চলছে না যে আড়ি পেতে শত্রুপক্ষের খবর জানতে হবে৷ এই ধরনের আইন বা কাজ আমাদের দেশের সংবিধান ও আইন বিরোধী,’’ বলেন নূর খান৷

সুত্র: ডয়চে ভেলে


Spread the love