বাংলাদেশে মার্কিন নীতির সমালোচনা করে বাইডেনকে চিঠি


Md. Hasib Uddin প্রকাশের সময় : জুলাই ৩, ২০২৩, ৬:৪৬ অপরাহ্ন / ৭৪
বাংলাদেশে মার্কিন নীতির সমালোচনা করে বাইডেনকে চিঠি
Spread the love

বাংলাদেশের বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক নীতির সমালোচনা করে দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন নীতি এবং বক্তৃতা শুধু মাত্র সন্ত্রাসবাদীদের অনুপ্রাণিত করছে এবং উদারপন্থি শক্তিকে বিভ্রান্ত করছে। সহিংসতামুক্ত, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ নিয়ে বাইডেনের বর্তমান অবস্থান পরিবর্তনের জন্যও ওই চিঠিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

মুসলিম দেশগুলোতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির ‘বারবার ব্যর্থতার’ বিষয়টি চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। একইসঙ্গে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, বাংলাদেশের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ নিয়েও।

চিঠিতে সই করেছেন বাংলাদেশি-আমেরিকান নির্বাচিত কয়েকজন কর্মকর্তা, মানবাধিকারকর্মী ও সামাজিক-পেশাজীবী সংগঠনের প্রতিনিধিরা। পহেলা জুলাই ওই চিঠি প্রেসিডেন্ট বাইডেন বরাবর পাঠানো হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, ‘সম্প্রতি আমরা আপনার প্রশাসনের কিছু পদক্ষেপ এবং কিছু আইন প্রণেতাদের বক্তব্য বাংলাদেশ বিরোধী বক্তব্যের মতন লক্ষ্য করছি এবং এই পদক্ষেপগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। আমরা এসব ঘটনা নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং বিনীতভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে প্রতিফলিত করে এমন পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করছি। যে পদক্ষেপ বাংলাদেশকে সহিংসতামুক্ত একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।’

চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্র দুটি বিরোধী শক্তিতে ভরপুর। একটি, বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ উদার আদর্শ এবং অন্যটি রাজনৈতিক জঙ্গিবাদের সাথে মিশ্রিত ধর্মীয় উগ্রবাদ। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং অপরটির নেতৃত্ব রয়েছে বিএনপি-জামায়াত অক্ষ। সাম্প্রতিক মার্কিন নীতি এবং বক্তৃতা শুধু মাত্র সন্ত্রাসবাদীদের অনুপ্রাণিত করছে এবং উদারপন্থি শক্তিকে বিভ্রান্ত করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ জানিয়ে বলা হয়, বাংলাদেশের জন্য সহিংসতামুক্ত, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে আমরা আপনাকে বর্তমান কর্মপন্থা পরিবর্তন করার জন্য বিনীতভাবে অনুরোধ করছি।

চিঠিতে বলা হয়েছে, আমরা বাংলাদেশি-আমেরিকান নির্বাচিত কর্মকর্তা, মানবাধিকার, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৌশলকে জোরালোভাবে সমর্থন করি। বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আমরা আপনার প্রশাসনের উদ্বেগের প্রশংসা করলেও, মার্কিন নীতিকে অবশ্যই বাংলাদেশে ব্যাপক সন্ত্রাসবাদের ঘটনা বিবেচনা করতে হবে যা সরাসরি বিএনপি-জামাত জোটের পৃষ্ঠপোষকতায় অন্যান্য সন্ত্রাসী সংগঠন দ্বারা সংঘটিত হয়েছে।

‘মুসলিম দেশ ও অঞ্চলের ঐতিহাসিক ও সামাজিক-রাজনৈতিক মাত্রা বিবেচনা না করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির বারবার ব্যর্থতার বিষয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া এবং লিবিয়া আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতার উজ্জ্বল উদাহরণ। আমরা বাংলাদেশে তা চাই না। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা থেকে দেখা যাচ্ছে যে শুধু মাত্র অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানই উদার গণতান্ত্রিক ফলাফলের নিশ্চয়তা দেয় না।’

২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ইসলামি জোটের জয়লাভের বিষয়টি চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, বিজয়ের পরপরই জোট বাংলাদেশের ১১টি জেলাজুড়ে হিন্দুধর্মাবলম্বী ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালায়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ভোট দেওয়ার জন্য হিন্দু ও বিরোধী কর্মীদের টার্গেট করা হয়েছিল। সহিংসতার ফলে ব্যাপক লুটপাট এবং বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া, হিন্দু নারীদের ধর্ষণ এবং হিন্দুদের উচ্ছেদ করা হয়। এটি ২০০১ -২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে চলতে থাকে, কিছু ক্ষেত্রে জোট নেতাদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায়।

চিঠিতে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতায় বড় ধরনের সহিংসতার ঘটনাগুলো তুলে ধরা হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে:

  • ২০০৪ সালে ২৪ মে বাংলাদেশের হরকাত-উল-জিহাদ আল-ইসলামী ওরফে হুজি কর্তৃক তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর উপর গ্রেনেড হামলা। এতে তিনজন নিহত এবং হাইকমিশনারসহ ৫০ জন আহত হয়।
  • ২০০৪ সালের ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ সন্ত্রাসী এই ঘটনা হুজি দ্বারা সংঘটিত হয়। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে ওই হামলায় ২৪ জন নিহত হন। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীসহ পাঁচ শতাধিক মানুষ আহত হন। ওই ঘটনায় বিএনপি-জামাত জোট শুধু ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়নি, বরং একজন দরিদ্র জজ মিয়া এবং একজন আওয়ামী লীগ কর্মী শৈবাল সাহা পার্থকে মিথ্যাভাবে জড়িয়ে একটি নাটক মঞ্চস্থ করেছে। জঘন্য অপরাধের কথা স্বীকার করার জন্য দুজনকেই নির্যাতন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক ও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে, হুজি নেতা মুফতি আবদুল হান্নান হামলার কথা স্বীকার করে। ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে তারেক জিয়া, বিএনপির বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন চেয়ারম্যান, লুৎফুজ্জামান বাবর, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, আবদুস সালাম পিন্টু, তৎকালীন উপ-মন্ত্রী প্রমাণিত হন। এ ঘটনায় ১৭ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং তারেকসহ অন্যান্য ১৮ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
  • ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমজেবি) ৬৪টি জেলা জুড়ে একযোগে ৪৫৯টি বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে দুইজন নিহত এবং প্রায় ১০০ জন আহত হয়। হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন বাংলা ভাই নামে পরিচিত শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম। বাংলাভাই কলেজে পড়ার সময় সাবেক ইসলামী ছাত্রশিবির (জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন) করতেন।
  • ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোটের শীর্ষ নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় জেএমজেবি এবং হুজি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি এবং সাংস্কৃতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য হামলা চালিয়েছে। তারেক রহমান ও বেশ কয়েকজন বিএনপির মন্ত্রী সরাসরি জেএমবির জঘন্য কর্মকাণ্ডের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন।
  • ২০০৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইউনূস জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের নৃশংস হামলায় প্রাণ হারান।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, এসব উদাহরণ ২০০১ সালের অবাধ নির্বাচন গণতান্ত্রিক ফলাফল নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছিল। এখন, সন্ত্রাসী ঘটনা ও অন্যান্য অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত তারেক জিয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। আমাদের উদ্বেগ হলো, তারেক জিয়া ও অন্য আসামিরা কোনোভাবে পেছনের দরজা দিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হলে কোন ধরনের গণতন্ত্র নিরাপদ হবে?

‘এতদিন রাজনৈতিক কার্যালয়ের বাইরে থাকার পরও বিএনপি-জামায়াত জোট তাদের সহিংস পথ ছেড়েছে বলে মনে হয় না। ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩-এ জামায়াত-ই-ইসলামী নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করার পর, জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা দেশজুড়ে এক অভূতপূর্ব বছরব্যাপী সহিংসতা চালায়। যার ফলে শত শত প্রাণ যায়। এই সহিংসতার কারণে দেশের ইতিহাসে বিএনপি-জামায়াত সমর্থকদের হাতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তার মৃত্যু হয়েছে। তারপর আবার, ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে, বিএনপি-জামায়াত বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে সরকারকে অস্থিতিশীল করার জন্য ব্যাপক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালায়। ওই সময় বোমা হামলায় ৬০ জনেরও বেশি নিহত হয়েছিলেন এবং আহতের সংখ্যা শতাধিক। ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি প্রতিবেদনে বিএনপি-নেতৃত্বাধীন প্রচারণার কঠোর সমালোচনা করে বলা হয়, ‘যেভাবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভগুলি পরিচালিত হচ্ছে তা স্পষ্টতই দেখায় যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা সহিংসতার পুনরাবৃত্তির প্যাটার্ন।’

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে বিপত্তি সত্ত্বেও, ইউএস-বাংলাদেশ সম্পর্কের ৫০ বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নতি হয়েছে। আমরা পারস্পরিক অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে দুই দেশের মধ্যে শক্তিশালী সম্পর্ক কামনা করি।

চিঠিতে সই করেছেন:

১। নির্বাচিত বাংলাদেশী-আমেরিকান কর্মকর্তা হলেন: কাউন্সিলম্যান ড. নুরুন নবী, এনজে; মেয়র মাহাবুবুল আলম তৈয়ুব, পিএ; রাজ্য প্রতিনিধি আবুল খান, এনএইচ; কাউন্সিলম্যান আবু আহমেদ মুসা, এমআই এবং কাউন্সিলম্যান নুরুল হাসান, পিএ।

২। সম্প্রীতি ফোরামের অধ্যাপক এবিএম নাসির, এনসি।

৩। ইউএসএ বঙ্গবন্ধু পরিষদের প্রকৌশলী রানা হাসান মাহমুদ, সিএ এবং প্রকৌশলী স্বীকৃতি বড়ুয়া, এনওয়াই।

৪। বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার ভেটেরান্স ১৯৭১, ইউএসএ ইনকর্পোরেটেডের গোলাম মোস্তফা খান মিরাজ।

৫। ক্যালিফোর্নিয়া বঙ্গবন্ধু পরিষদের নজরুল আলম।

৬। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, ইউএসএ-এর ফাহিম রেজা নূর, এনওয়াই।

৭। মিশিগান বঙ্গবন্ধু পরিষদের ইঞ্জিনিয়ার আহাদ আহমেদ।

৮। ইউএসএ কমিটি ফর ডেমোক্রেটিক অ্যান্ড সেক্যুলার বাংলাদেশের জাকারিয়া চৌধুরী।

৯। জর্জিয়া বঙ্গবন্ধু পরিষদের মাহাবুবুর রহমান ভূঁইয়া।

১০। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ, ইউএসএ-এর খুরশীদ আনোয়ার বাবলু।

১১। গ্রেটার ওয়াশিংটন ডিসি বঙ্গবন্ধু পরিষদের দস্তগীর জাহাঙ্গীর।

১২। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ড. আব্দুল বাতেন।

১৩। ম্যাসাচুসেটস বঙ্গবন্ধু পরিষদের সফেদা বসু।

১৪। মোরশেদ আলম, গণতান্ত্রিক নেতা, এনওয়াই।

১৫। পেনসিলভানিয়া বঙ্গবন্ধু পরিষদের আবু তাহের বীর প্রতীক।

১৬। অ্যাকাডেমিক গ্রুপের মধ্যে: প্রফেসর জিয়াউদ্দিন আহমেদ, পিএ; প্রফেসর মিজান আর মিয়া, আইএল; প্রফেসর জামিল তালুকদার, ডব্লিউআই এবং প্রফেসর শাহাদাত হোসেন, এনওয়াই।

১৭। দক্ষিণ নিউ জার্সি বঙ্গবন্ধু পরিষদের নূরন্নবী চৌধুরী।

 


Spread the love