আঙুল পরিষ্কারের নামে ছাপ নিয়ে নিবন্ধন হচ্ছে সিম! অজান্তেই বিক্রি হচ্ছে ব্যক্তিগত তথ্য


Md. Hasib Uddin প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৩, ৫:১২ পূর্বাহ্ন / ৫৬
আঙুল পরিষ্কারের নামে ছাপ নিয়ে নিবন্ধন হচ্ছে সিম! অজান্তেই বিক্রি হচ্ছে ব্যক্তিগত তথ্য
Spread the love

আপনি কোনো অপারেটরের সিম কিনতে গেছেন, বায়োমেট্রিক (আঙুলের ছাপ) দেওয়ার সময় দোকানি জানালেন, ছাপ ভালোভাবে আসছে না। আপনার আঙুল তৈলাক্ত বা ময়লা রয়েছে। এরপর সেই আঙুল পরিষ্কার করা হলো কোনো রাবার বা প্লাস্টিকের প্যাডে। এখান থেকেই সর্বনাশের শুরু। গোপনে সংরক্ষণ করে রাখা হলো আপনার আঙুলের ছাপ। এরপর তা দিয়ে আপনার নামে কেনা হলো নানা অপারেটরের সিম! অথচ আপনি কিছুই জানেন না।

সাইবার পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, কেউ সিম কিনতে গেলে হাতের আঙুল পরিষ্কার করার নামে রাবার সাদৃশ্য বস্তুতে গ্লু-গানের মাধ্যমে ফিঙ্গার প্রিন্ট বা আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করে রাখে চক্রটি। এরপর রাবারে সংরক্ষণ করে রাখা আঙুলের ছাপ ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অজান্তে জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে সিম রেজিস্ট্রেশন করে নেয়। সেই সিম অতিউচ্চমূল্যে বিক্রি করা হতো অপরাধীদের কাছে। কিন্তু যার নামে রেজিস্ট্রেশন করা, তিনি এর কিছুই জানতেন না।

সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের সদস্যরা ওই চক্রের আট সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর এ তথ্য বেরিয়ে আসে। শুধু তাই নয়, এ চক্রের প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বিশেষ অ্যাপস তৈরি করে তা দিয়ে যে কোনো ব্যক্তির মোবাইল ফোনের কললিস্ট ও অবস্থান শনাক্ত করে তাও অপরাধীদের হাতে তুলে দিত।

গ্রেপ্তাররা হলো মো. মাসুদ (২২), মেহেদী হাসান (২৪), আল আমিন মিয়া (২৬), আরাফাত রহমান (২৩), নুর আলম (২৪), ইমন হোসেন (২৫), সোহেল রানা (৩৬) ও মো. শাকিল (২৫)। মেহেদী দলটির প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ। অন্যরা বিভিন্ন মোবাইল অপারেটর কোম্পানির সেলস রিপ্রেজেনটেটিভ (এসআর) পদে কর্মরত।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, এ চক্রটি ‘ডিজিটাল সার্ভিস প্রো.’ নামে ফেসবুক পেজ ও হোয়াটসঅ্যাপে নানা গ্রুপ খুলে উচ্চমূল্যে নিবন্ধনহীন সিম বিক্রি করছিল। ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের সদস্যরা তদন্তে নেমে নিশ্চিত হন, তারা ব্যক্তির অজান্তে বায়োমেট্রিক সংরক্ষণ করে তা দিয়ে সিম নিবন্ধন করে আসছে। শুধু তাই নয়, তারা ‘টিকটক প্রো’ ও ডিজিটাল প্রো সার্ভিস’ নামে বিশেষ ধরনের অ্যাপস তৈরি করে ব্যক্তির কললিস্ট, এসএমএস লিস্ট, সিম লোকেশনও বের করে সেগুলোও বিক্রি করে আসছিল। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে বায়োমেট্রিক, এনআইডি নম্বরসহ নানা ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে তা বিক্রি করছিল। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন মোবাইল অপারেটর কোম্পানির কিছু অসৎ কর্মীদের যোগসূত্র পাওয়া গেছে।

তিনি আরও বলেন, এ ধরনের প্রতারণা এড়াতে মোবাইল কোম্পানিগুলো থেকে যাতে বায়োমেট্রিক বা এনআইডির তথ্য ফাঁস না হয়, সেদিকে বিশেষ নজর থাকা উচিত। তা ছাড়া নিজেদের সেলস সেন্টার ও কাস্টমার কেয়ার প্রতিনিধিদের ওপর নজরদারি থাকা দরকার। এর বাইরে যেসব ওয়েবসাইট থেকে এনআইডি নম্বরের বিপরীতে ব্যক্তির তথ্য পাওয়ার সুযোগ থাকে, সেসব ওয়েবসাইটে নিরাপত্তামূলক প্রশ্ন থাকা উচিত।

সাইবার পুলিশের অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, কেউ সিম ক্রয় করতে গেলে সতর্কতার সঙ্গে বায়োমেট্রিক দিতে হবে। নিজের নামে কয়টি সিম রেজিস্ট্রেশন করা আছে, তাও মাঝেমধ্যে দেখা উচিত।

ওই অভিযানে থাকা ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, এই চক্রটি কত বছর ধরে এ ধরনের ভয়ংকর কাজ করছিল এবং কী পরিমাণ সিম ব্যক্তির অজান্তে নিবন্ধন করেছে, সে বিষয়ে তদন্ত চলছে। এ চক্রটি অবৈধ ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের সার্ভার হ্যাক করেও তথ্য হাতিয়ে নিত।

ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের (উত্তর) অতিরিক্ত উপকমিশনার জুনায়েদ আলম সরকার কালবেলাকে বলেন, চক্রটি ব্যক্তির অজান্তে সিম নিবন্ধন করে সেগুলো মূলত মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারকদের হাতে তুলে দিত। এ প্রতারকরা টাকা হাতিয়ে নিলেও তাদের আইনের আওতায় আনা যেত না। তা ছাড়া ভুয়া নিবন্ধিত সিম দিয়ে নানা ধরনের অপরাধ করলেও অপরাধীরা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। তারা বিশেষ কায়দায় ব্যক্তির ফিঙ্গার প্রিন্ট সংরক্ষণ করে তা দিয়ে সিম নিবন্ধন করে প্রতিটি সিম ২ হাজার টাকা বা এর চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করে আসছিল। এ ছাড়া, তাদের কাছে ব্যক্তির আঙুলের ছাপ, জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যসহ নানা তথ্য থাকায় বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করে তারা টাকা হাতিয়ে নিত।

ডিবির সাইবার বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, চক্রের মূলহোতা মাসুদ একসময় একটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানির এসআর পদে চাকরি করত। প্রযুক্তিতে বিশেষ পারদর্শী মাসুদ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এপিআই সংগ্রহ করে তথ্য হাতিয়ে নিত। তাকে সহায়তা করত একই মোবাইল অপারেটর কোম্পানির ইমন হোসেন, সোহেল রানা ও শাকিল। চক্রটির প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মেহেদী অ্যাপস তৈরি করে বিভিন্ন ব্যক্তির কললিস্ট বের করে ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করত। অন্য একটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানির এসআর নুর আলম টাকার বিনিময়ে দুই ভাই আল আমিন ও আরাফাতের কাছ থেকে গোপনে সংগ্রহ করা বায়োমেট্রিক দিয়ে সিম নিবন্ধন করত।

 


Spread the love